
রূপকথার ঝুলি পড়ছিলাম খাটের নিচে শুয়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছিলাম কারণ আমার ছোট বোনদেরও পড়া চাই ওই গল্পগুলো। কিন্তু, আমি চাই আমিই আগে পড়বো!
ঠাকুরমার ঝুলির একটা বড় সংগ্রহ ছিল আমার। স্কুলে পদ্য লেখার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে পেতাম ঠাকুরমার ঝুলিসহ রূপকথার গল্পের বইগুলো। মা ও গল্পের বই পড়তেন অনেক। আমার গল্পের বই পড়ার হাতেখড়ি হয় মায়ের আশীর্বাদেই।
তখন স্কুলের বৃত্তির টাকাগুলো জমিয়ে কিনতাম রহস্যপত্রিকাগুলো। প্রাচীনে স্কুলের সহপাঠীদের সাথে বই বিনিময়ের একটা প্রথা যেন ছিল। আসলে ওটা ঠিক বিনিময় নয়, এটা ছিল এরকম যে, আমার একটা বই পড়া হয়ে গেল কিন্তু সহপাঠীদের কেও হয়ত ওটা পড়েনি, আমি ওকে দিলাম ওই বইটা পড়ার জন্য তখন ও আমাকে দিল অন্য বইটা যেটা আমি পড়িনি তখনও। বইটা পড়া হয়ে গেলে আমি ওকে ওটা ফেরৎ দিয়ে আমার বইটা নিয়ে আসব।

ধীরে ধীরে এভাবেই জ্ঞানের পরিধি বাড়ছিল শৈশবের সময়ে। প্রতিদিন বিকেলেই সহপাঠীদের সাথে বসতাম প্রাচীন ওই মাতৃসম গোমতী নদীর পাশে ক্ষীরা ক্ষেতের বাঁশের মাচায়। আলাপ ছিল গল্পের বইগুলোর কোন একটা গল্প নিয়ে। বাড়ন্ত ওই জ্ঞানে ছিল নিখাদ ভালোবাসা আর গভীর প্রানে জেনেছিলাম, আসলে সহপাঠীদের সবাই যেন আত্মার আত্মীয়রা এই পৃথিবীতে।
এভাবেই ধীরে ধীরে প্রায় সবার ঘরেই গড়ে উঠেছিল বইয়ের সংগ্রহগুলো।
পুরনো গল্পের বইগুলোর অমূল্য পৃষ্ঠাগুলো এখন প্রায়ই খুঁজে পাই আমি বাজারের ঠোঙাগুলোয়। বইয়ের তাকগুলো আজকাল খুব অপ্রয়োজনীয় বা ওই তাকে রাখা বইগুলোই হয়ত আরও বেশী অপ্রয়োজনীয়। তাই বইগুলো বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হয়ত পাওয়া যাবে। ওই টাকা দিয়ে একটা দামী মুঠোফোনের বিকল্প আর কি হতে পারে? এখন পৃথিবী অনেক সহজ হয়ে গেছে ইন্টারনেটের বিষাক্ত আশীর্বাদে।
কিন্তু, বই পড়া আর হয়ে উঠে না তেমন। অভিশপ্ত এই আধুনিক বৈদ্যুতিক বইয়ে পুরনো বইয়ের ঘ্রাণের উপস্থিতি নেই।
প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়টাতে শান্তির চিহ্নমাত্রও বিলুপ্ত আজ। কারণ, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির যন্ত্রগুলো অথবা এগুলোর তৈরি সামগ্রীগুলো তো প্রাকৃতিক নয়। এটাই হল প্রকৃতির প্রতিশোধ ও অভিশাপ।